সংবাদ
খাদ্য সংকট পরিস্থিতি ও করনীয়
মো. রায়হান আলী: করোনার প্রভাব ও ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ পরিস্থিতে বৈশ্বিক অর্থনীতি অনেকটা নাজুক হয়ে পড়েছে। অনেক বিশ্লেষক বলছে জনগণের মধ্যে একটা নীরব দুর্ভিক্ষ চলমান। ২০২৩ সালে বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দার পূর্বাভাস দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বলছে, যুদ্ধ পরিস্থিতি দ্রæত স্বাভাবিক না হলে দুর্ভিক্ষও দেখা দিতে পারে। এছাড়াও অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষ থেকে ২০২৩ সালের সম্ভাব্য খাদ্য ঘাটতির আশঙ্কা সংক্রান্তে নানান ধরনের সতর্ক বার্তা দেয়া হচ্ছে।
বিশ্বের ৮২টি দেশের অন্তত ৩৪ কোটি ৫০ লাখ মানুষ তীব্র খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার ভুগছে বলে জানিয়েছেন জাতিসংঘের খাদ্য নিরাপত্তা বিভাগের প্রধান ডেভিড বিসলি। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশের সাধারণ মানুষ নানান সমস্যায় ভুগছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এর প্রভাব পড়ছে।
সারা বিশ্ব তেল-গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকটে ভুগছে। বিশ্ব বাজার নিত্যপন্ন দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বমূখী, মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। সর্বত্রই যেন একটা মন্দা ভাব ও সংকটের সময় বিশ্বের সাথে আমরাও অতিবাহিত করছি। পণ্যদ্রব্যের দাম যে হারে বেড়েছে সে হারে শ্রমের মূল্য বাড়েনি। যে হারে বাসা ভাড়া সহ সার্বিক ব্যয়ভার আমাদের কাঁধের উপর চেপে বসেছে, সে হারে আমাদের আয়ের পরিমাণ বাড়েনি। তাই পূর্বের স্বাভাবিক জীবনে আমাদের একটা হতাশা নেমে এসেছে। সবাই আয়-ব্যয়ের সমান্তরাল ঠিক করতে নানানভাবে জীবন-জীবিকার ব্যয়ভার কমানোর চেষ্টা করছি। মানুষ মৌলিক চাহিদা মেটার পর অবশিষ্ট অর্থ থাকলে একটু স্বস্তির চিন্তা করে। মৌলিক চাহিদার সবচেয়ে অন্যতম হল মানুষের পেটে ভাত দরকার। আমাদের দেশ কৃষি নির্ভর দেশ। আমরা কৃষির উপর নির্ভর করে দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে সব সময় চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। ২০২০-২১ অর্থবছরে জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ১৩ দশমিক ৪৭ শতাংশ। ২০১৮ সালের বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমীক্ষার তথ্যমতে, এটি মোট শ্রমশক্তির ৪০.৬ ভাগ যোগান দিয়ে থাকে এবং দেশের জিডিপিতে এর অবদান ১৪.১০ শতাংশ।
বৈশ্বিক মন্দা পরিস্থিতিতে আমাদের এই কৃষি নির্ভরতার উপরেও পড়েছে নানান প্রভাব। কৃষিতে সাফল্য পেতে হলে কৃষকের মুখে হাসি থাকতে হয় কিন্তু কৃষকেরা ফসল ফলাতে এখন অনেকাংশে আগ্রহ হারাচ্ছে। কৃষকরা বলছে-কৃষি উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে কয়েকগুন। কৃষি সরঞ্জাম সহ সার, কীটনাশক, শ্রমিক ব্যয়ভার বেড়ে গেছে। তারপরও নানান প্রাকৃতিক দুর্যোগের হানা কৃষি উৎপাদনে। আমাদের দেশের জনগণ বেড়েছে কিন্তু জমি তো বাড়েনি। তাই দিন দিন আমাদের অল্প জমিতে অধিক ফসল ফলানোর কৌশলকে আরও বেগবান করা দরকার কিন্তু কৃষির উপাদানের ব্যয়ভার বৃদ্ধির কারণে খাদ্য সংকটের বর্তমান পরিস্থিতিতে পড়েছি আমরা। এ সংকট নিরসনে বিশ্বের সাথে আমরাও বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করে পরিস্থিতি অনূকুলে আনার চেষ্টা করছি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বেশ কয়েকবার দুর্ভিক্ষ পূর্ববর্তী প্রস্তুতি নেয়ার জন্য দেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহবান জানিয়েছেন।
খাদ্য ঘাটতি পরিস্থিতি প্রসঙ্গে, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘সবাইকে অনুরোধ করব কারও কোনো এলাকায় ১ ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে। কারণ সারা বিশ্বে এখন যে অর্থনৈতিক মন্দা সৃষ্টি হয়েছে- আমি যখন জাতিসংঘে গিয়েছি সেখানে অনেক দেশের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে, সবাই খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত যে ২০২৩ সালে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে। আরও ব্যাপক অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে আমি বলব আমাদের দেশের মানুষকে এখন থেকেই ব্যবস্থা নিতে হবে’।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিএফপি) এরই মধ্যে সতর্ক করে বলেছে যে ২০২৩ সালে বিশ্বের ৪৫টি দেশে তীব্র খাদ্য ঘাটতি দেখা দিতে পারে। এবং ২০ কোটি মানুষের জন্য জরুরি সহায়তার প্রয়োজন হতে পারে।
গত অক্টোবর প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ইকনোমিক আউটলুক প্রতিবেদনে আইএমএফ বলেছে, ২০২৩ সালে একটি মারাত্মক মন্দার মুখোমুখি হতে পারে বিশ্ব অর্থনীতি। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নেমে যেতে পারে ২ দশমিক ৭ শতাংশে।
এদেশের অতীত ইতিহাস বলে স্বাধীনতা পরবর্তী ১৯৭৪ এর দুর্ভিক্ষ বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালের মার্চে শুরু হয়ে সেই বছরেরই ডিসেম্বরের দিকে গিয়ে শেষ হয়। এই দুর্ভিক্ষে অসংখ্য মানুষ অনাহারে মারা গিয়েছিল। সরকারি হিসাব অনুসারে ২৭,০০০ মানুষ অনাহারে মৃত্যুবরণ করে। বেসরকারি হিসাবে অনুমানিক ১,০০,০০০ থেকে ৪,৫০,০০০ জন প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে মৃত্যুবরণ করে। এই দুর্ভিক্ষকে স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ানক হিসেবে গন্য করা হয়। এখন এমন কঠিন দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা আমরা করছি না। আমরা আধুনিক কৃষিখাতকে অত্যাধিক গুরুত্ব দিচ্ছি। অল্প জমিতে অধিক ফসল ফলানোর কৌশল আমাদের কৃষকরা শিখে গেছে। এখন শুধু খাদ্যের উৎপাদন বৃদ্ধিতে কৃষকদের কৃষি ঋণ,তাদের মনোবল ও কৃষি ফসলের ন্যায্য মূল্য দিতে পাড়লে আমাদের খাদ্য ঘাটতি হয়ত থাকবে না। খাদ্যের ঘাটতি পূরণে আমাদের আতঙ্কিত না হয়ে কৃষি খাতকে যুগোপযোগী আধুনিকায়ন করতে হবে। বিশ্বের সাথে আমরাও এ পরিস্থিতি সঠিক পরিকল্পনায় মোকাবিলা করে সামনে এগিয়ে যেতে চাই।
বিশ্ব খাদ্য পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিশ্ব নেতারা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশনেত্রীও সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় শুধু সরকারের উপর দায় চাপিয়ে আমাদের বসে থাকলে চলবে না। জীবন-যাপনে আমাদের মিতব্যয়ী হতে হবে, অপচয় রোধ করতে হবে। সরকারি উদ্যোগ বৃদ্ধির পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগকে আরও বেগবান করতে হবে। দেশের কৃষিখাতকে কিভাবে আরও চাঙ্গা করা যায় তার সমন্বিত পরিকল্পনা করতে হবে। কৃষকের মুখের হাসি কিভাবে ফোটানো যায় সেটার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। দেশের যত অর্থনৈকিক জোন আছে সেগুলোর গতিশীলতা তরান্বিত করতে হবে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি, গ্যাস ব্যবহারে আমাদের সকলকে আরও মিতব্যয়ী হতে হবে।
লেখক: আইনজীবী ও কলামিস্ট