সংবাদ
বন্ধ হয়ে গেছে ঢাকা না’গঞ্জ রেল চলাচল
ব্রিটিশ আমলে প্রথম মিটারগেজ রেল লাইন স্থাপিত ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেপথে গতকাল রবিবার থেকে ট্রেন চলাচল অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছে। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ যাত্রীরা। অফিসগামী চাকুরীজীবীদের আসা যাওয়ার খরচ বেড়ে যাওয়ায় অনেকে একে মরার উপর খাড়ার ঘা বলে মন্তব্য করেছেন। গতকাল রোববার নারায়ণগঞ্জ থেকে কোনো ট্রেন ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যায়নি কিংবা ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জেও আসেনি। সবশেষ গত শনিবার রাত ৮টা ৪০ মিনিটের নির্ধারিত ট্রেনটি ২০ মিনিট দেরিতে নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যায়। রেললাইনে কাজের জন্য ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকলেও সকাল থেকে হাজার হাজার যাত্রী নারায়ণগঞ্জ কেন্দ্রীয় রেলস্টেশন, চাষাঢ়া ও ফতুল্লা রেলস্টেশনে ভিড় করেন। তারা স্টেশন মাস্টারদের কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এর মধ্যে নি¤œ আয়ের যেসব মানুষ ঢাকাস্থ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন তাদের স্বল্প ব্যয়ের যাতায়াতের মাধ্যম ছিল ট্রেন। সেটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন তারা। ট্রেনে ১৫ টাকায় ঢাকায় যেতেন তারা। এখন অন্তত ৬৫ টাকা দিয়ে বাসে চড়ে তাদের ঢাকায় যেতে হচ্ছে। এ নিয়ে যাত্রীদের মাঝে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ কেন্দ্রীয় রেলস্টেশনের মাস্টার কামরুল জানান, আমাদের এখানে সকাল থেকেই হাজার হাজার যাত্রী ভিড় করছেন। কয়দিন আগেই নোটিশ দেওয়া হয়েছে এবং তথ্য প্রচার করা হয়েছে। তবুও অনেকে মানতে চাইছেন না। বিশেষ করে নি¤œ আয়ের অনেকে তীব্র ক্ষোভ জানাচ্ছেন। আজ কোনো ট্রেন ছেড়ে যায়নি বা আসেনি। কতদিন পর ট্রেন চলাচল শুরু হবে তা জানানো হয়নি। চাষাঢ়া রেলস্টেশনের মাস্টার জানান, আমরা আগেই জানিয়েছি বিষয়টি। এখন যাত্রীরা চাইছেন দ্রুততম সময়ে ট্রেন চালু হোক। ট্রেন বন্ধ তবে কবে চালু হবে, তার কোনো নির্দিষ্ট সময় এখনো জানানো হয়নি। তবে পদ্মা সেতুর সাথে রেল সংযোগের কাজের কারণে সাড়ে ৩ মাসের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা’ রেলপথ ছিল রেল ইতিহাসে অন্যতম। স্থাপিত হয়েছিল ১৮৮৫ সালের ৪ জানুয়ারি। ১৪.৯৮ কিলোমিটার ওই পথই ছিল রেলের স্বর্ণযুগ। কিন্তু রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও দায়িত্বহীনতায় ঐতিহ্যের এ রেলপথ এখন রূপকথায় পরিণত হয়েছে। প্রায় ১৩৭ বছর আগে এ পথটি উদ্বোধন হলেও যুগে যুগে শুধু ধ্বংসই হয়েছে। শুরুতে লাইন, স্টেশনে আধুনিকতা আর ঐতিহ্যের ছোঁয়া থাকলেও এখন তলানিতে ঠেকেছে। নামমাত্র ট্রেন চলছে-সেবা নেই বললেই চলে। চরম অব্যবস্থাপনার মধ্যে চালানোর কারণে একটু উনিশ-বিশ হলেই ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে দুর্ঘটনা ঘটছে। মারা যাচ্ছে যাত্রী ও পথচারী। স্বাধীনতার পর থেকে রেলসেবা কমতে থাকে। চলমান রেলপথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বাড়তে থাকে ঝুঁকি। বর্তমান সরকারের এক যুগে রেল উন্নয়নে আমূল পরিবর্তন এলেও এ পথে এখনো উন্নয়ন প্রকল্প শেষ হয়নি। স্বাধীনতার পরও এ পথে উন্নত সেবা আর নিরাপত্তা নিয়ে ট্রেন চলাচল করছিল। ৮০ দশকের পর থেকেই হারাতে থাকে এর ঐতিহ্য। ক্ষয় হতে থাকে লাইন, বিলুপ্ত হতে থাকে লাইনের যন্ত্রাংশ। জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে স্টেশনগুলো। এ পথে রেলের সবচেয়ে জরাজীর্ণ ট্রেনগুলো ব্যবহৃত হয়ে আসছে। গত কয়েক বছর এ পথে ‘ডেমু’ ট্রেন চালানো হচ্ছে। ডেমুকে ইতোমধ্যে খোদ রেলওয়ে কর্মকর্তারাই ‘গলার কাঁটা’ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। নেই টয়লেটের কোনো ব্যবস্থা। একদিন চললে দুদিন নষ্ট থাকে। অথচ অল্প দূরত্বের এ রেলপথেই সবচেয়ে বেশি যাত্রী চলাচল করে। চাহিদা রয়েছে বর্তমানে যে পরিমাণ যাত্রী চলাচল করে তার চেয়ে প্রায় ১০০ গুণ বেশি। এ হিসাব রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের। বর্তমানে মৃতপ্রায় লাইন দিয়ে ১৭ ঘণ্টায় ২৬ জোড়া ট্রেন চলে। চলমান লাইন সংস্কার এবং ২য় ও ৩য় লাইন স্থাপন হলে উল্লেখিত সময়ে প্রায় ৯০ জোড়া ট্রেন চালানো সম্ভব হবে। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেলপথের উন্নয়ন না হলেও বাকি রেলপথে উন্নয়ন হয়েছে। একের পর এক উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণও করা হয়েছে। ক্ষোভ প্রকাশ করে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেলপথে চলা যাত্রী আবুল হোসেন জানান, ব্রিটিশ আমল থেকেই যাত্রী ও মালামাল আনা-নেওয়ায় অন্যতম ছিল এ রেলপথ। স্বাধীনতার পর থেকেই এ পথ রূপ হারাতে থাকে। এজন্য দায়ী খোদ রেলওয়ে কর্মকর্তারা। বড় প্রকল্প মানেই বড় দুর্নীতি-অনিয়ম। কম দূরত্বের এ পথে কোনো কর্মকর্তাই নজর দেননি। জানাগেছে, কমলাপুর স্টেশন থেকে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লাইন এবং পদ্মা সেতু প্রকল্পের রেললাইন পাশাপাশি গেছে গে-ারিয়া পর্যন্ত। সেখান থেকে পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের লাইন কেরানীগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর, মাওয়া, পদ্মা সেতু হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা জংশন দিয়ে যশোর পর্যন্ত যাবে। ১৬৯ কিলোমিটার দীর্ঘ এই ডুয়েলগেজ লইন নির্মাণে ব্যয় হবে ৪০ হাজার কোটি টাকা। এদিকে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লাইনও ডাবল লাইন ও ডুয়েল গেজে রূপান্তরের কাজ চলছে, সেজন্য সাড়ে ৬০০ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। অর্থাৎ কমলাপুর থেকে গে-ারিয়া পর্যন্ত ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ বিদ্যমান মিটারগেজ লাইনটি ডুয়েলগেজে উন্নীত হবে এবং পাশে আরেকটি নতুন ডুয়েলগেজ লাইন নির্মাণ করা হবে। এখনকার লাইনের আরেকপাশে আরেকটি ডুয়েলগেজ লাইন হবে পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পে জন্য। ১২ দশমিক ১ কিলোমিটার দীর্ঘ ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেলপথে প্রতিদিন ২৬টি ট্রেন চলে। তাতে পাশাপাশি দুই নগরে যাতায়াত করেন ৩০ হাজারের মত যাত্রী। ট্রেন বন্ধ থাকলে সেই চাপ পড়বে সড়কে।