সংবাদ
বরিশালে হত্যাকান্ডের শিকার নুরুল ফকির
ফতুল্লা প্রতিনিধি
বরিশালে ডেকে নিয়ে হত্যাকান্ডের শিকার হওয়া নুরুল আমিন ফকিরের দাফন সম্পূর্ন হয়েছে। মঙ্গলবার (২৫ সেপ্টেম্বর) রাত সাড়ে ১০টায় নিহত নূরুল আমিনকে লক্ষীনগর ফকির বাড়ি পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। এর আগে রাত সাড়ে ৯টায় নিহতের লাশ তার নিজ বাড়ি লক্ষীনগরে বরিশাল হতে আনা হয়। পরে জানাযা নামাজ লক্ষীনগর জামে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে অনুষ্ঠিত হয়।
জানা যায়, নারায়ণগঞ্জের সদর উপজেলার বক্তাবলী লক্ষীনগর গ্রামের পিয়ার আলী ফকিরের ছেলে নিহত নুরুল আমিন ফকির। অন্যদিকে খুনী কামরুল ইসলাম একই এলাকার হানিফ ফকিরের ছেলে। তার শ্বশুরবাড়ি বরিশালের মুলাদী উপজেলার সফিপুর ইউনিয়নের বোয়ালিয়া গ্রামে। এর আগে এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে পুলিশ কামরুল ইসলামের শ্বশুর মোঃ খোরশেদ আলমকে গ্রেফতার করে জেলহাজতে পাঠায়।
নুরুল আমিনকে যে ভাবে নেয়া হয় বরিশাল ঃ
খুনী কামরুল ফকির পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী বারবার নুরুল আমিন ফকিরকে বরিশাল যেতে মোবাইল ফোনে কল দিতে থাকে। াওয়ার টাকা তার কাছে নেই বললে খুনী কামরুল ফকির তার ছোট ভাই আরিফ ফকিরকে দিয়ে ৩০০০/ টাকা পাঠায়। টাকা পেয়ে নুরুল আমিন ফকির একা বরিশালের মুলাদীর উদ্দেশ্য ১০ অক্টোবর রওনা দেয়।
যে ভাবে খুন হয় নুরুল আমিন ফকির ঃ
নিহতের স্বজনরা জানান, ১০ তারিখ রাতেই খুনী কামরুল ফকির, তার সহযোগী খোরশেদ আলম,কামরুলের স্ত্রী তামান্না, তার বাবা হানিফা ফকির,ছোট ভাই ইয়াবা খোর পিয়ার হোসেন ফকির,আরিফ ফকির,শাশুড়ী ও সমন্ধির সহ অজ্ঞাত নামা কয়েকজন খুনির সহযোগিতায় ট্রলার ভাড়া করে নদীতে খুন করে লাশের হাত পা বেঁধে ইটের সাথে নদীতে ফেলে দেয়।
যে ভাবে লাশ উদ্ধার করে নৌ পুলিশ ঃ
গত ১২ অক্টোবর নদীতে ভাসমান অবস্থায় নদী হতে বরিশাল নৌ পুলিশ নুরুল আমিন ফকিরের লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য লাশ মর্গে প্রেরন করে। প্রাথমিক ভাবে পরিচয় না পাওয়ায় বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফন করা হয়। পরে নিহত নুরুল আমিন ফকিরের স্বজনরা বরিশাল গিয়ে পুলিশের তোলা লাশের ছবির সাথে তাদের নিয়ে যাওয়া ছবি মিলে যায়। সনাক্ত হয় নুরুল আমিন ফকির।
আদালতের নির্দেশে লাশ উত্তোলন ঃ
বরিশাল চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতের শরনাপন্ন হন নুরুল আমিন ফকিরের স্বজন লাশ পেতে। গত ২৩ অক্টোবর বিজ্ঞ বিচারক লাশ উত্তোলন করে স্বজনদের নিকট হস্তান্তর করার নির্দেশ দেন। ঘুর্নিঝড় সিত্রাং এর কারনে ২৪ অক্টোবর লাশ উত্তোলন করা সম্ভব হয়নি। পরে ২৫ অক্টোবর লাশ উত্তোলন করে স্বজনরা বরিশাল হতে রওয়ানা হন।
নিজ বাড়িতে নিহত নুরুল আমিন ফকির ঃ
স্বজন ও এলাকার ব্যক্তিদের সার্বিক সহযোগিতায় অবশেষে ২৫ অক্টোবর রাত সাড়ে ৯ টায় এম্বুলেন্স যোগে খুন হওয়া নুরুল আমিন ফকিরের লাশ তার নিজ বাড়িতে আসে। যেখানে তার শিশু ও বাল্যকাল কাটছিল। লাশ পৌছার সাথে সাথে স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও এলাকাবাসীর কান্নায় পরিবেশ ভারী হয়ে উঠে।
স্কুল মাঠে জানাযা ঃ
লক্ষ্মীনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে রাত ১০ টায় নুরুল আমিন ফকিরের জানাযা নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় ১ হাজার মানুষ জানাযা নামাজে অংশ গ্রহন। এদের মধ্যে সমাজ প্রধান শহীদুল্লাহ্ ফকির, সাবেক মেম্বার জয়নাল আবেদীন ফকির, রাসেদুল হক রাসেল, মতিউর রহমান ফকির, ফারুক ফকির, আতাউর রহমান ফকির, রিয়াদ চিশতী ও ফয়সাল সহ এলাকার গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ।
পারিবারিক কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত ঃ
রাত সাড়ে ১০ টায় ফকির বাড়ি পারিবারিক কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত হন নুরুল আমিন ফকির।শোক ও অশ্রুসিক্ত নয়নে চিরবিদায় জানান স্বজন ও এলাকাবাসী।
আদালতে যা বললেন খুনী খোরশেদ আলম ঃ
বরিশাল আদালতে খুনী খোরশেদ স্বীকার করেছেন, তার জামাতা কামরুল ইসলাম খুন করে দেশ ছেড়ে সিঙ্গাপুর চলে গেছে। এ খুনের সঙ্গে আর কেউ জড়িত আছে কিনা তা তিনি জানেন না।
গত ১২ অক্টোবর রাতে উপজেলার নাজিরপুর ইউনিয়নের সাহেবেরচর গ্রামের আড়িয়াল খাঁ নদীর উত্তর তীরবর্তী চর থেকে নূরুল আমিনের মরদেহ উদ্ধার করে নৌপুলিশ। মরদেহের হাত-পায়ে ইট বাঁধা পাওয়ায় প্রাথমিকভাবে হত্যার সন্দেহ করা হয়। ঘটনার পরদিন নৌপুলিশ বাদী হয়ে মুলাদী থানায় মামলা করে। বিভিন্ন থানায় সংবাদ পাঠিয়ে মরদেহের পরিচয় শনাক্ত না হওয়ায় বেওয়ারিশ হিসেবে বরিশালেই নূরুল আমিনকে দাফন করা হয়। গত সোমবার নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানার একটি সাধারণ ডায়েরির (জিডি) সূত্র ধরে নূরুল আমিনের মরদেহের পরিচয় শনাক্ত হয়।
জানা গেছে, গত ১০ অক্টোবর বাসা থেকে বের হয়ে মুলাদীতে আসেন নূরুল আমিন। পরবর্তীতে মোবাইল ফোন বন্ধ পেয়ে তার বোন সোনিয়া আক্তার ১৪ অক্টোবর ফতুল্লা মডেল থানায় জিডি ডায়েরি করেন।
নিহতের বোন সোনিয়া আক্তার জানান, নূরুল আমিন ও কামরুল ইসলাম একসঙ্গে সিঙ্গাপুর ছিলেন। তারা একসঙ্গে সেখানে থাকতেন। বাংলাদেশ থেকে সিঙ্গাপুর লোক নেওয়ার ব্যবসাও (আদম ব্যবসা) করতেন তারা। নূরুল আমিন সিঙ্গাপুরে থাকাকালীন কামরুল তার কাছ থেকে ১৫ লাখ টাকা নেন। এক বছর আগে নূরুল আমিন সিঙ্গাপুর থেকে বাড়িতে আসেন। পরবর্তীতে নূরুল আমিনকে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে নেওয়ার কথা বলে আরও ১০ লাখ টাকা নেন কামরুল কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে না নেওয়ায় তিনি ২৫ লাখ টাকা ফেরত চান। কিন্তু কামরুল ইসলাম আজ-কাল করে সময়ক্ষেপণ করতে থাকেন।
তিনি আরও জানান, গত ৭ অক্টোবর গোপনে বাংলাদেশে আসেন কামরুল। এলাকার লোকজন টাকার জন্য চাপ দেবেন এই ভয়ে নিজ গ্রামে যাননি তিনি। নূরুল আমিনকে মোবাইল ফোনে ইমুতে কামরুল তার শ্বশুরবাড়ি মুলাদীতে আসতে বলেন। কিন্তু টাকা না থাকায় আসতে পারবেন না জানিয়ে দেন নূরুল আমিন। পরে কামরুল ইসলাম তার ছোটভাই আরিফের মাধ্যমে নূরুল আমিনকে ৩ হাজার টাকা দেন। গত ১০ অক্টোবর সকালে নূরুল আমিন বাসা থেকে বের হন। ওই সময় নূরুল আমিন জানিয়েছিলেন, কামরুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলতে বরিশালের মুলাদীতে যাচ্ছেন।
পরিবারের সদস্যদের ধারণা, পাওনা টাকা চাওয়ায় কামরুল তার শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সহায়তায় নূরুল আমিনকে হত্যা করেছেন।
নাজিরপুর নৌপুলিশ ফাঁড়ি ইনচার্জ প্রবীর মিত্র বলেন, কামরুলের পাসপোর্ট তদন্তে দেখা গেছে তিনি ৭ অক্টোবর বাংলাদেশে এসেছেন এবং ১৩ অক্টোবর সকালে সিঙ্গাপুর চলে গেছেন। বাংলাদেশে অবস্থানকালীন তিনি তার শ্বশুরবাড়ি মুলাদী উপজেলার বোয়ালিয়া গ্রামে ছিলেন। এছাড়া কামরুল ইসলামের শ্বশুর খোরশেদ আলম গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন যে, তার জামাতা মোবাইল ফোনে নূরুল আমিনকে ডেকে এনে খুন করেছেন এবং সিঙ্গাপুর চলে গেছেন। হত্যার সঙ্গে জড়িত অন্যদের শনাক্ত এবং গ্রেফতারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।