সংবাদ
বিদ্যুৎ সংকট নিরসনে বিকল্প চিন্তা করুন
আহসান হাবিব:
বর্তমান সরকার প্রধান কথায় কথায় বলে থাকেন বাংলাদেশের একটি ঘরও অন্ধকারে থাকবে না। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া হবে। সেই অনুযায়ী দেশেও এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই বিদ্যুৎ বিপর্যয়। কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে বিশ্ব যখন ক্ষতি সামলে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সেই গতিকে পুনরায় শ্লথ করে দিয়েছে। রাশিয়া বিশ্বের অন্যতম প্রধান জ্বালানি তেল, গ্যাস উৎপাদনকারী এবং রপ্তানিকারক দেশ। এ কারণে যুদ্ধ শুরুর পর দেশটির তেল সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকে বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে শুরু করে। জ্বালানি তেলের দামের পাশাপাশি গ্যাসের দামও আকাশ ছুঁয়েছে। এমতাবস্থায় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সংকটও সৃষ্টি করেছে। এরই মধ্যে পোল্যান্ড ও বুলগেরিয়ায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে রাশিয়া। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মারাত্মক বিরূপ প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। এই যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম আরো বাড়বে, এর প্রভাবে দেশে পরিবহন ভাড়া ও কৃষি খাতে উৎপাদন খরচ বেড়েছে এবং কোন অবস্থায় যাবে এখনো তা বোঝা যাচ্ছে না। জ্বালানি সংকটে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ দরকার তা পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে উৎপাদন কমেছে। পরিস্থিতি কোনদিকে গড়াবে তা বোঝা যাচ্ছে না।
বিদ্যুতের জাতীয় সঞ্চালন লাইনে গ্রিড বিপর্যয়ের কারণে ৪ অক্টোবর একযোগে সারাদেশে বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটে। ৭ ঘণ্টা সারাদেশ বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে। তবে রাত ৮টার পর থেকে বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুৎ আসা শুরু করে।
বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের ঘটনায় পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) দুই প্রকৌশলীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। দায়িত্বে ‘অবহেলা’ করায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সংশ্লিষ্টদের মতে, বিদ্যুৎবিভ্রাটের কারণে আর্থিকভাবে বিভিন্ন খাতে ২ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়।
প্রসঙ্গত, এর আগে ২০১৭ সালে গ্রিড বিপর্যয়ে কয়েক ঘণ্টা বিদ্যুৎহীন ছিল দেশের উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৩২ জেলা। এর আগে ২০০২, ২০০৭ ও ২০০৯ সালেও গ্রিড বিপর্যয়ের বড় ঘটনা ঘটে। দেশে কি এমন হলো যে, হঠাৎ করে দেশব্যাপী বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংকট দেখা দিল। রাজধানীসহ সারাদেশে লোডশেডিং বৃদ্ধি পেয়েছে। একবার বিদ্যুৎ চলে গেলে আর সহজে আসতে চায় না। বিশেষ করে গ্রামে যারা বাস করেন তাদের জীবন হাঁসফাঁস অবস্থা। জ্বালানি তেল ও গ্যাস সংকটের কারণে প্রতিদিন দুই থেকে চার ঘণ্টার লোডশেডিংয়ে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। লোডশেডিংয়ের কারণে ডিজেল কিনে জেনারেটর চালানোয় খরচ বেড়ে যাচ্ছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানে উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। উৎপাদন খরচ বাড়ায় ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন তারা। অনেকে সময়মতো শিপমেন্ট করতে পারছে না। বিদ্যুতের এই সংকট কতদিন চলবে, এখনই বলতে পাচ্ছেন না সরকারসহ বিদ্যুৎ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন শপিং মলসহ সব ধরনের দোকান রাত ৮টার পর বাধ্যতামূলকভাবে বন্ধ করে দিতে হয়। এর বিরূপ প্রভাবও পড়েছে ওই এলাকার ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদের ওপর। প্রতিদিন তিন-পাঁচ ঘণ্টা বিদ্যুৎ না থাকায় কাজ অনেক কম হচ্ছে। বিদ্যুৎ না থাকায় শ্রমিকদের কাজের পরিমাণ কমে গেছে।
নীলক্ষেতের সব ধরনের লিফলেট, ব্যানার, পোস্টার প্রিন্টিংয়ের কাজ করা হয়। পুরোপুরি উৎপাদনমুখী ব্যবসা। আগে প্রতিদিন পাঁচ হাজার টাকার প্রিন্টিংয়ের কাজ হতো, এখন তা দুই থেকে তিন হাজারে হচ্ছে। এ ব্যবসা যেহেতু বিদ্যুৎ ছাড়া সম্ভব নয়। বিদ্যুৎ না থাকলে সব বন্ধ। উৎপাদন বন্ধ থাকলেও ঘরভাড়া, শ্রমিকদের বেতন মাসিক ভিত্তিতে কিন্তু দিতেই হয়। অথচ উৎপাদন হচ্ছে কম। কালি-কাগজের দাম বেড়েছে। যে ব্যবসা হচ্ছে তাতে এখন ঘরভাড়া দেয়াই কঠিন। বিদ্যুৎ সংকটের কারণে শুধু ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প নয়, সব ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ক্ষতির সম্মুখীন। গত কয়েক বছরের উন্নয়নের প্রধান কারণই ছিল বিদ্যুৎ সংকট না থাকা। লোডশেডিংয়ের জন্য কিছু সাশ্রয় হচ্ছে, কিন্তু বিদ্যুৎ না থাকার কারণে যে মানুষের হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে, তার দায়ভার কে নেবে? যেভাবেই হোক বিদ্যুৎ সংকট সমাধানে সরকারকে দ্রুত চিন্তা করতে হবে। না হলে গত ১০-১২ বছরে যে উন্নয়ন হয়েছে, সেটা কিন্তু টেকসই উন্নয়ন হিসেবে থাকবে না। এজন্য আমাদের বড় ধরনের মূল্য দিতে হবে। সরকারের একার প্রচেষ্টায় এ ধরনের কাজ সম্ভব নয়। তাছাড়া জনগণও সরকারের বাইরে নয়। তাই সংকটের এই সময়ে সবাইকে সাশ্রয়ী হতে হবে। বিদ্যুৎ উৎপাদন নিয়ে বিকল্প চিন্তা না করলে এ সংকট নিরসন কষ্টকর হবে।
বিদ্যুৎ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, রেকর্ড সৃষ্টি করা, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়া সরকারের ‘সিগনেচার ক্যাম্পেইন’। তবে গত দুই থেকে তিন মাস ধরে বিদ্যুতের ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে এসব ক্যাম্পেইন সাধারণ মানুষের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। কেন এই সংকট তার ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। এই সংকট শুধু আমাদের দেশেই নয়, উন্নত বিশ্বের দেশগুলোও সংকটে পড়েছে। যুক্তরাজ্য, জাপান, জার্মানির মতো অন্যান্য উন্নত দেশও জ্বালানি সংকটের মধ্যে রয়েছে। সেখানে বিদ্যুতের ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়ার ওপর জোর দেয়া হচ্ছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি সংকট কতদিন চলবে তা অনিশ্চিত। এ কারণে উন্নত দেশগুলো বিশ্ববাজার থেকে অধিক হারে জ্বালানি সংগ্রহ করে রিজার্ভ গড়ে তোলায় সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে।
উপমহাদেশের দেশগুলোও জ্বালানি সংকটের মধ্যে পড়েছে। পাকিস্তানে সংকট দেখা দেয়ায় বিদ্যুৎ ব্যবহারে কৃচ্ছ্রসাধন করে চলেছে। জ্বালানি সংকটে শ্রীলঙ্কার কী শোচনীয় অবস্থা দাঁড়িয়েছে, তা সকলেরই জানা। দেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকটকে পর্যবেক্ষকরা শ্রীলঙ্কার মতো হওয়ার ‘পূর্বাভাস’ হিসেবে গণ্য করে এখন থেকেই সংশ্লিষ্টদের সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এ আশঙ্কা থেকে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের ব্যবস্থা নেয়া এবং অপচয় রোধ করা ছাড়া উপায় নেই বলে তারা মত দিয়েছেন। তা নাহলে, দিন যত যাবে সংকট আরও তীব্র হয়ে উঠবে। শুধু লোডশেডিং করে এ সমস্যার সমাধান করা যাবে না। এজন্য যেসব কমগুরুত্বপূর্ণ এবং অপ্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে বিদ্যুতের ব্যবহার রয়েছে, সেগুলো চিহ্নিত করে বিদ্যুৎ সাশ্রয় করতে হবে।
বিদ্যুৎ সংকট মোকাবেলায় সাশ্রয়ী হওয়া এবং কৃচ্ছ্রসাধনের বিকল্প নেই। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে খুঁজে বের করতে হবে, কোথায় কোথায় বিদ্যুতের অপচয় হয়, অপ্রয়োজনীয়তা রয়েছে এবং কোথায় বিদ্যুৎ সাশ্রয় করা যায়- এসব বিষয় খতিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। যেখানে যেখানে বিদ্যুৎ সাশ্রয় করা যেতে পারে সেখানেই তা করার ব্যবস্থা নিতে হবে। এমন অনেক অপ্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা রয়েছে যেখানে বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। রাজধানীসহ বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কে বিদ্যুৎচালিত বিজ্ঞাপনী বিলবোর্ড রয়েছে সেগুলো সময় নির্দিষ্ট করে বন্ধ রাখার পরিকল্পনা করা যেতে পারে। অফিসের সময়সূচি কমিয়ে কাজের গতি বাড়িয়ে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের চিন্তা করতে হবে।
আমরা দেখেছি, এমন অনেক জায়গা রয়েছে যেখানে অপ্রয়োজনীয়ভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হয়। এসব অপ্রয়োজনীয় স্থান চিহ্নিত করতে হবে। যেসব অবৈধ সংযোগ রয়েছে, সেগুলো বন্ধের উদ্যোগ নিতে হবে। বছরের পর বছর ধরে চলা সিস্টেম লস নিরসনে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। বিদ্যুৎ সরবরাহ নির্বিঘœ করতে দেশের অভ্যন্তরে গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধির ওপর জোর দিতে হবে। যেসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ পাওয়া যায় না অথচ সরকারকে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে, সেগুলো বন্ধ করার চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। সারাদেশে প্রচুর বিদ্যুৎ অপচয় হচ্ছে। বিদ্যুৎসংশ্লিষ্ট অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী আছে, যারা টাকার বিনিময়ে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে সরকারকে রাজস্ব থেকে বঞ্চিত করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। কোনো ধরনের ব্লেম গেইমে না গিয়ে বিশ্ব বাস্তবতার নিরিখে বিচার-বিশ্লেষণ করে বিদ্যুৎ সঞ্চয় ও সাশ্রয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট