সংবাদ
ভূ-পর্যটক রামনাথ বিশ্বাসের স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি
আমার প্রতিজ্ঞা ছিল, যতদিন আমি আমার পর্যটন সমাপ্ত না করব ততদিন কোনো বন্ধনে আবদ্ধ হব না। আমার আত্মীয়-স্বজনরা আমার একরোখা স্বভাবের কথা ভালভাবেই জানতেন, সেজন্যই তারা আমাকে বিরক্ত করেননি। কিন্তু, মাটির টান অপরূপ। বাংলাদেশের সীমানা ছাড়বার সঙ্গে সঙ্গে আমার অজ্ঞাতসারেই চোখের জল গালের উপর গড়িয়ে পড়ল। বুঝলাম জগতের সব ঠাঁই ঘর থাকলেও মানুষের সত্যিকার ঘর একটিই, যে ঘর অকটোপাশের মত মানুষের সমস্ত হৃদয়টাকে দৃঢ় বন্ধনে বেঁধে রেখেছে, সে ঘরটি মাতৃভুমি।’- প্রথম বাঙালি ভূ-পর্যটক রামনাথ বিশ্বাস তার লিখা ‘আফগানিস্থানের ভ্রমণ’ বইটিতে প্রিয় জন্মভূমির কথা এভাবেই তুলে ধরেন।
তিনি ১৮৯৪ সালের ১৩ জানুয়ারি হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলার বিদ্যাভূষণ পাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। মাতা ছিলেন গুণময়ী দেবী এবং পিতা বিরজানাথ বিশ্বাস। রামনাথ বিশ্বাস একজন বিশ্বমানের ভ‚-পর্যটকের পাশাপাশি লেখক হিসেবেও খ্যাত ছিলেন। মোটর কারখানায় চাকরির সুবাদে তিনি মোটর সাইকেল ও বাইসাইকেল চালনায় বিশেষ পারদর্শী হয়ে উঠেন। তাই, প্রায় শত বছর পূর্বে ১৯৩১ সালে একটি বাইসাইকেল নিয়ে বিশ্ব ভ্রমণে বের হন। সাথে নিয়েছিলেন এক জোড়া চটি জুতা ও দুটি চাদর। বাইসাইকেলের ক্যারিয়ারের বাক্সে ছিল সাইকেল মেরামতের সরঞ্জাম। ভ্রমণের প্রতি নেশার কারণেই তিনি দু’চাকা দিয়ে সারা বিশ্ব ভ্রমণ করেছিলেন। বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে ভারী করেছেন অভিজ্ঞতার ঝুলি। তার দু’চাকা ভ্রমণে দেখা দেশ, মানুষ, সমাজ, সভ্যতা ও সংস্কৃতির অভিজ্ঞতার কথা তিনি বিভিন্ন বইয়ে লিপিবদ্ধ করেন। এছাড়াও লিখেছেন বিভিন্ন গল্প, উপন্যাস। তার ভ্রমণ বিষয়ক বইয়ের সংখ্যা ৩০টি। সব মিলিয়ে লেখা গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ৫০টিরও অধিক। তার ভ্রমণ কাহিনী আনন্দবাজার পত্রিকায় ধারাবহিকভাবে প্রকাশ করা হতো। পরে গ্রন্থ আকারে তা প্রকাশিত হয়। তিনবার সাইকেলে চড়ে ১৯৩১ থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত চারটি মহাদেশ ভ্রমণের কারণে তিনি বেশি স্বীকৃত। তিনি তৃতীয়বারের মতো ভ্রমণে বেরিয়ে ১৯৪০ সালে দেশে ফিরেন। তাতে তিনি ভ্রমণ করেন প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার বর্গমাইল। ততক্ষণে ভারত বিভক্তি আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। পাড়ি জমান ভারতে।
কিন্তু, মনেপ্রাণে নিজ গ্রামের প্রতি প্রবল ভালবাসা ছিল। সেজন্যই রামনাথ ১৯৩৪ সালে তার সম্মানে গ্রামবাসী বানিয়াচং ঐতিহাসিক এড়ালিয়া মাঠে এক বিশাল সংবর্ধনার আয়াজন করা হলে সেদিন রামনাথ বিশ্বাস বলেছিলেন, ‘বাইন্যাচুং (বানিয়াচং) আমার দুইন্যাই’। অথচ, প্রিয় স্বদেশে স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি বেদখল হয়ে আছে। বর্তমানে বসতভিটার পাশাপাশি একটি দৃষ্টিনন্দন মন্দির ও পুকুর রয়েছে। কিন্তু, এগুলোর শেষ রক্ষা হলো না। রামনাথ বিশ্বাস ভারতে যাওয়ার পর তার ভাইও পরিবার পরিজন নিয়ে ভারতে চলে যান। তাই, রামনাথের জš§ভিটা অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে সরকারি খাতিয়ানে চলে যায়। সে হিসেবে এ সম্পত্তির মালিক বাংলাদেশ সরকার। কিন্তু, দুঃখজনক হচ্ছে, রামনাথ বিশ্বাসের বাড়ি দীর্ঘদিন ধরে দখল করে রেখেছে একটি পরিবার। দখল করা পুরনো সকল ভবন ভেঙ্গে ফেলেছে দখলদাররা। স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা অনেক চেষ্টা করেও বাড়িটি দখলমুক্ত করতে পারেনি। বাড়িটি দেখতে গিয়ে কয়েকবার হামলার শিকার হয়েছেন সাংবাদিক ও পর্যটক। সর্বশেষ গত ১১ সেপ্টেম্বর কয়েকজন সাংবাদিক পেশাগত দায়িত্ব পালণকালে ভ‚-পর্যটক রামনাথের বাড়ি দেখতে গেলে তাদের উপর হামলা চালানো হয়। বর্তমানে বাড়িতে থাকা পুরনো সকল ভবন ভেঙ্গে ফেলেছে দখলদাররা। শুধুমাত্র মন্দিরের একটি অংশ এখনও দাঁড়িয়ে আছে। পুকুরে দখলদাররা মাছ চাষ করছেন (দৈনিক জনকণ্ঠ, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২)।
সম্পদের প্রতি তার ছিল প্রবল অনীহা। সেজন্য, পৈতৃক ভিটার ৪ একর ৪৮ শতাংশ জমি ফেলে চলে যান ভারতে। ভ্রমণের ক্ষেত্রেও তিনি মনে করতেন খরচের অতিরিক্ত টাকা জমা রাখা বিড়ম্বনা। তাই প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকা বিলিয়ে দিয়েছেন গরীবদের মাঝে। যে লোকটির সম্পত্তির প্রতি কখনও মোহ তৈরি হয়নি তার পৈতৃক ভিটা আজ অন্যের দখলে।
বাঙালি সমাজের জন্য সম্মান বয়ে নিয়ে আসা মানুষটির বাড়িটি পুনরুদ্ধারের জন্য অনেকে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সে উদ্দেশ্যে বিশ্ব পর্যটন দিবসে গত ২৭ সেপ্টেম্বর রামনাথ বিশ্বাসের বাড়ি পুনরুদ্ধার ও সেখানে জাদুঘর স্থাপনের দাবিতে বাইসাইকেল শোভাযাত্রা হয়েছে। ভ‚-পর্যটক রামনাথ বিশ্বাসের বসতভিটা পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ কমিটির উদ্যোগে এই শোভাযাত্রায় বিভিন্ন সাইক্লিস্টরা অংশ নিয়েছেন। তারা বানিয়াচং যাওয়ার পথে ভূপর্যটক রামনাথ বিশ্বাস সম্পর্কে মানুষকে অবগত করেন এবং তার স্মৃতিবিজরিত বাড়িটি পুনরুদ্ধারের দাবির প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। পরে বানিয়াচং শহীদ মিনারে এসে একটি প্রতীকী অনশন কর্মসূচিও পালণ করেন তারা। এছাড়াও রামনাথের বসতভিটা পুনরুদ্ধার করে সেখানে একটি পাঠাগার, একটি সাইকেল মিউজিয়াম ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের উদ্যোগ নেয়ার দাবি জানিয়েছে কমিটি। তিনি ১৯৫৫ সালে ১ নভেম্বর তিনি পরলোক গমণ করেন।
ভূ-পর্যটক রামনাথ বিশ্বাসের জন্মস্থান হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে, প্রচারের অভাবে তা এখনও অনেকের কাছে অজানা। অথচ, কলকাতায় তার নামে একটি সড়ক রয়েছে। রামনাথ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে শ্যামনুন্দর বসু বলেন, অন্ত্যজ শ্রেণির সঙ্গে অবলীলায় তাদের মতো করেই মিশে যেতেন। ফলে তারাও পর্যটকদের কাছে হৃদয়ের দরজা খুলে দিত। শ্যামসুন্দর বসু ‘রামনাথের পৃথিবী’ নামে একটি বইও লিখেন। রামনাথ বিশ্বাস এ দেশের ভ্রমণপিপাসুদের কাছে অনুপ্রেরণাময় ব্যক্তি। তার স্মৃতি বিজরিত বাড়িটি দখলমুক্ত করে সংরক্ষণ করা উচিত। বেদখল হওয়া জমি উদ্ধার করে ভ‚-পর্যটকের স্মৃতি ধরে রাখতে বাড়িতে পাঠাগার কিংবা জাদুঘর তৈরি করা যেতে পারে।
লেখক: ব্যাংক কর্মকর্তা ও কলামিস্ট।